ধর্মীয় সংস্থার কর্মকর্তা -কর্মচারীদেরকে সবসময় অনিয়ম-দুর্নীতির উর্ধ্বে থাকতে হলেও ইসলামিক ফাউণ্ডেশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক তৌহিদুল আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। আর্থিক অনিয়ম থেকে শুরু করে স্বজনপ্রীতিসহ সকল ধরণের অনিয়ম-দূর্নীতি দাপটের সাথে করে যাচ্ছেন এই কর্মকর্তা। শিক্ষা জীবন থেকে তিনি জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে এসেছেন অতি সুকৌশলে।
তৌহিদুল আনোয়ার চট্টগ্রামের সন্দীপ উপজেলার বাউরিয়া ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডে ওবায়েদুল হকের ছেলে । এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্কুল জীবনে তিনি ছাত্র-শিবির করতেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত মেজর জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মেজর রফিক উল্লাহর ভাগিনা হওয়ার সুবাদে তিনি ১৯৯৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিদায় মুহূর্তে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে চাকরি পেতে সক্ষম হন। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সচিবের বাড়ী সন্দীপ হওয়ার কারণে জামাতপন্থী হওয়ার পরেও চাকুরী জীবনে কোন সমস্যা হওয়া তো দূরের কথা পেছনেও ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। উল্টো যেখানে কর্মরত ছিলেন সেখানেই জড়িয়েছেন নানা বিতর্কে।
জানা যায়, নিজেকে সাবেক এক সচিবের বেয়াই পরিচয় দিয়ে তিনি সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করেন। তার বিভিন্ন কর্মকান্ডের জন্য সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ইসলামি ফাউন্ডেশনের মনিটরিং কমিটি, জমিয়াতুল ফালাহ – আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের মুসল্লী ও মসজিদ কমিটি এবং খ্যাতনামা আলেম-ওলামা, পীর, মাশায়েখ ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে তার দ্বন্দ্ব সার্বক্ষনিক। জামায়াতপন্থী আলেমদের সাথে তার নিয়মিত ওঠা-বসা এবং শিবির ও জামায়তপন্থী নেতা-কর্মীদের সাথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী সরকার পতনের লক্ষ্য ও নাশকতার জন্য গোপন বৈঠকে মিলিত হন বলে জানা যায়। তার রোষানলে পড়ে ইসলামি ফাউন্ডেশনে তার অধীনস্থ বিভিন্ন দপ্তরের উপ পরিচালক, উপ সহকারী পরিচালক, ফিল্ড অফিসার, ফিল্ড সুপারভাইজার, মডেল কেয়ারটেকার, সাধারণ কেয়ারটেকার, গণশিক্ষার শিক্ষক -শিক্ষিকাকে মিথ্যা অপবাদে সন্ত্রাসী কায়দায় শোকজ ধরিয়ে দেন এবং চাকরী ছাড়তে বাধ্য করেন। অন্যথায় চাকরী থেকে বরখাস্ত করার হুমকি প্রদান করেন। এছাড়া তার উর্ধ্বতন সম্মানিত কর্মকর্তা মহাপরিচালক, প্রকল্প পরিচালক ও বিভিন্ন দফতরের পরিচালকবৃন্দের সাথে বিরূপ আচরণ এবং কৌশলে তাদের একে অপরের সাথে সম্পর্ক বিনষ্ট করে। একে অপরের বিরুদ্ধে নামে বেনামে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ প্রেরণ করতেও এই কর্মকর্তা খুব পটু। কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী তার কথায় না চললে তাকে চাকরী হারিয়ে পথে বসানোর হুমকি দেন।
রাঙ্গামাটিতে দায়িত্ব পালন করার সময় পাহাড়ি -বাঙ্গালী সম্পৃতি নষ্টের অভিযোগে স্থানীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার ও জনসংহতির সভাপতি সন্তু লারমার সাথে বিবাদে জড়িয়ে চাকরী থেকে বরখাস্ত হলেও নিজের স্বভাব বদলাননি তিনি। এই সময় তিনি প্রায় ৫লক্ষ আত্মসাৎ করেন মর্মে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে দায়িত্ব পালনের সময় ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের সাইনবোর্ডে “প্রতিষ্ঠাতা জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” উল্লেখ করার বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাকবিতন্ডা হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তা উল্লেখ করেন নি।
কোন সংবাদকর্মী প্রতিবেদনের জন্য এই কর্মকর্তার বক্তব্য চাইলে নিজেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী বলে হুমকি প্রদান করেন। সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এবং আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া তাঁর জুনিয়র ব্যাচে ছিলেন বলেও দাম্ভিকতা দেখান তিনি।
জানা যায়, ১৯৯৬ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ সময়ে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে সহকারী-জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। জামাত শিবিরের মদদে বাংলাদেশ জমিয়তুল মুদারিসিনের বিপরীত সংগঠন বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি জামাত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদী ও সেক্রেটারী টঙ্গী তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদীনের পৃষ্টপোষকতায় এই চাকুরী পান। পরবর্তীতে তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি না নিয়ে সাবেক মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজালের সুদৃষ্টিতে একলাফে উপ পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। বিভিন্ন কর্মস্থলে ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও কম নয় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
একাধিক বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের পাহাড়িকা আবাসিক এলাকায় একতা ভবন নামের ৬তলা একটি ভবনের একাংশের মালিক তৌহিদুল আনোয়ার । ১৯৮৬ সালে ছাত্রশিবির চবির আবাসিক হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আশপাশের জায়গাগুলো জামায়াতপন্থীরা দখল করে মালিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে কমদামে ক্রয় করেন। এসবের বাইরেও ঢাকা-চট্টগ্রামে তার একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক একবার বায়তুল মোকাররমের ইসলামিক ফাউণ্ডেশন কার্যালয়ে তৌহিদুল আনোয়ারকে দেখে তৎকালীন মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজালের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন শিবির ক্যাডার তৌহিদুল আনোয়ার এর স্থান এখানে হবে না। ঢাকা বিভাগের আশকোনা অফিসে দায়িত্ব পালনের সময় স্থানীয় সরকার দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়লে সেই অফিস থেকে তাঁকে হেনেস্থা ও অপমান করে তৎক্ষানিক বদলী করা হয়। তিনি যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানে জাতীয় কোন অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন না বলেও জানা যায়।
অভিযোগ রয়েছে, তৌহিদুল আনোয়ার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্য্যালয়ে আসার পর এই বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের সকল কর্মকান্ডে জামায়াতপন্থী লোকদের নিয়োজিত করেছেন। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে দায়িত্ব পালনের পর রীতিমতো টাকার কুমির হয়ে যান এই কর্মকর্তা। মসজিদ মাঠের বিরাট একটি অংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সকে ভাড়া দেওয়ার সময় বিরাট অংকের ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। কেননা যেই টাকায় মাঠের অংশটি ভাড়া দেওয়া হয় সেটার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। সেখানে একটি গাড়ী শো-রুম ভাড়া দিয়ে উক্ত ভাড়াগুলো সরকারি তহবিলে জমা না করে আত্বসাত করেন। এছাড়া জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ মাঠে যেসব অনুষ্ঠান হয় সেগুলোর বেশীরভাগ ফিঃ ও পানির বিল বাবদ টাকা তিনি ফান্ডে জমা না করে নিজে আত্মসাৎ করেন মর্মে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া ম্যাক্সকে দেওয়া জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ মাঠের ভাড়া চুক্তির মেয়াদান্তে ১০% হারে বৃদ্ধি করার কথা থাকলেও পরিচালক তৌহিদুল আনোয়ার অজ্ঞাত কারণে মাত্র ১% হারে ভাড়া বৃদ্ধি করে চুক্তি নবায়ন করেন মর্মে জানা যায়।
নাফরীন শো রুমের মালিক নাফিজ ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, এই শো রুমের জায়গা আমি ইসলামিক ফাউণ্ডেশন থেকে ভাড়া নিয়ে নিজ অর্থায়নে স্থাপনা নির্মান করি । ভাড়ার টাকা কোথায় প্রদান করা হয় এমন প্রশ্ন করলে তিনি ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের কথা উল্লেখ করেন।তৌহিদুল আনোয়ারের মন্তব্য অনুযায়ী ম্যাক্স থেকে সাবলেট নিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন ম্যাক্স শুধুমাত্র আমার প্রতিবেশী সুতরাং ম্যাক্স থেকে সাবলেট নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
এই ব্যাপারে তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী। অনেকে শত্রুতা করে আমাকে দূর্নীতিবাজ ও জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলে দাবী করলেও এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। গাড়ীর শো রুম ভাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটাও ম্যাক্সের। এটার জন্য আলাদা করে ভাড়া দেওয়া হয় না। ম্যাক্স সর্বমোট ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা ভাড়া দেন। আমি যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছি সেখানে সততা এবং অভিজ্ঞতার সাক্ষর রেখে আসছি। আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের মহাপরিচালক মনিম হাছান বলেন তৌহিদুল আনোয়ারের বিরুদ্ধে আমরা বিভিন্ন অভিযোগ পেয়েছি, সেগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত চলতেছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকলে সেগুলো প্রেরণেরও অনুরোধ জানান তিনি।