-
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, আন্দরকিল্লা, লালখান বাজার এলাকায় কখনো পানি দেখিনি। এখন সেখানেও পানি উঠছে। গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল সমস্যা সমাধান করতে পারলেই মাস্টার প্ল্যান করে সফলতা পাওয়া সম্ভব। মালয়েশিয়ায়ও বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি থাকে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে পানি আর থাকে না। তাদের ব্যবস্থা অনেক উন্নত। বর্তমান সময়ে পারা যায় না এমন কিছুই নেই। তাই মান্ধাতা আমলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম শহরকে বাঁচানো যাবে না। বাঁচাতে হলে উন্নত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। গতকাল চট্টগ্রাম নগরীর মাস্টার প্ল্যান (২০২০–২০৪১) প্রণয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ওয়ার্ড ভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য চসিকের কাউন্সিলরদের সাথে আয়োজিত অংশীজন সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র এসব কথা বলেন। নগরীর আন্দরকিল্লায় অবস্থিত চসিকের পুরাতন নগর ভবনে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলমের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ।
মেয়র আরও বলেন, জলবদ্ধতার সমাধান হচ্ছে না। পরিকল্পনা করে কাজ করলে সেটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। এখন শুষ্ক মৌসুম। এ সময়েও বাকলিয়া, চকবাজার এলাকার মানুষকে ভোগতে হচ্ছে। হাঁটু পানি, ময়লা পানি পেরিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। বাড়ির আঙ্গিনায় পানি, রাস্তায় পানি, মসজিদে যেতে হচ্ছে তা পার হয়ে। খাল ভরাট হয়ে গেছে, সেই সাথে পানি চলাচলে সমস্যা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খালে রিটেইনিং ওয়ালের দরকার নেই। শত শত বছর ধরে এ অবস্থা ছিল, তখন কী পানি যায় নি! খালের গভীরতা বাড়ানো হলে পানি এমনি এমনি নিচের দিকে নেমে যাবে। সিডিএ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, মার্চের আগে খালের মাটি উত্তোলনের ব্যবস্থা করুন। তা না হলে মানুষ কষ্ট পাবে। তারা কিন্তু তখন ছাড়বে না। মানুষ কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছে যে, কাজগুলো সিটি কর্পোরেশনের না। আমাদের ৭২ টা খাল ছিল, এখন ৩৬ টা আছে। আরো ২১ টা খাল প্রায় ধ্বংসের মুখে। এ অবস্থায় আমাদের খাল দখলমুক্ত করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিকল্পনা করলে হবে না শুধু। বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সাথে নতুন খাল সৃষ্টি করতে হবে বলেও বক্তব্যে বলেন তিনি।
মেয়র বলেন, আমাদের চট্টগ্রাম শহরটা হলো একটি পর্যটন নগরী। আমাদেরকে এটা মাথায় রেখেই মাস্টার প্ল্যান করা উচিৎ। এটা করা হলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। সম্প্রতি ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, তিনি বায়েজিদ লিংক রোড দিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিলেন। বলেছেন, চট্টগ্রাম শহরটা অনেক সুন্দর। যদিও লিংক রোডের দুই পাশ দেওয়াল হিসেবে আছে, ভেতরে কিছুই নাই, সব কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। আমাদের সেদিকে কোনো নজর নাই। যাইহোক, চট্টগ্রাম শহরে আরো অনেক নান্দনিক জায়গা রয়েছে। সেগুলোও যদি বিদেশীদের দেখানো যায়, তারা অবশ্যই মুগ্ধ হবেন।
চট্টগ্রাম শহরে অনেক পাহাড় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাহাড়গুলোকে আমরা সংরক্ষণ করতে পারছি না। হাউজিং করা হয়েছে। তা যদি না করতাম পাহাড় সুন্দর থাকতো। মাস্টার প্ল্যান করতে হলে পাহাড় সংরক্ষণ করতে হবে। ঘর–বাড়ি করতে হলে সিডিএ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তাব ছিল, মন্ত্রণালয়কে আমরা বলেছি, সিডিএ প্ল্যান দিবে, একই সাথে সিটি কর্পোরেশন থেকেও অনুমোদন নিতে হবে। এটা করা হলে রাস্তা থেকে যেটুকু দূরত্ব রেখে বাড়ি করার কথা সেটা রক্ষা হতো। মাস্টার প্ল্যান করলেই যে শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠবে এটা পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করেন না উল্লেখ করে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সন্তানরা ফার্মের মুরগির মতো বেড়ে উঠছে। পর্যাপ্ত পরিকল্পনা করে খেলার মাঠসহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক সুযোগ সুবিধা রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মকে নিয়ে ভাবতে হবে।
মেয়রের বক্তব্যের আগে সিডিএ চেয়ারম্যান, সভার সভাপতি, কাউন্সিলররা, চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপ–প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ইছা আনসারী এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের টিম লিডার ড. আহসানুল কবির বক্তব্য রাখনে। বক্তব্যে সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, আগে ঘরে বসে মাস্টার প্ল্যানের কাজ হয়েছে। এখন এলাকায় গিয়ে সবার সাথে কথা বলে এটি করা হবে। যেখানে শিক্ষক, উকিল সবার বক্তব্য নেওয়া হবে। যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয়।
এর আগে মাস্টার প্ল্যানের প্রাথমিক তথ্য সংরক্ষণ, পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের টিম লিডার ড. আহসানুল কবির। একপর্যায়ে বাস্তবসম্মত মহাপরিকল্পনা গড়ে তুলতে সিডিএ থেকে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রথম প্রস্তাবটি হচ্ছে, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, ওয়ার্ড সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা প্রতিনিধি (চিকিৎসক, প্রকৗশলী, শিক্ষাবিদ)’র সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি গ্রুপ তৈরি করা। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হলো– নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডকে ১০ জোনে ভাগ করে অংশী সভার আয়োজন করা। দুই থেকে তিনটি করে ওয়ার্ডকে সমন্বিত করে একটি করে জোন গড়ে তোলা। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এসব জোনের আপডেট তথ্য জানাতে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
বক্তব্যে চসিক কাউন্সিলরা বলেন– এক এক ওয়ার্ডের সমস্যার ধরণ ভিন্ন রকম। আবার পাশাপাশি ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে সড়ক সংযোগ, খালের পানি প্রবাহ সংযোগসহ বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত। তাই তাড়াহুড়ো করে চসিকের কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে মহাপরিকল্পনার জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হলে তাতে ভুল ভ্রান্তি হওয়ার সুযোগ থাকতে পারে। এতে করে ভবিষতে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। তাই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি ওয়ার্ড ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন অংশী সভার আয়োজন করা যায়।
সভায় চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদুল আলম বলেন, শব্দ দূষণের মতো সব রকম সমস্যা রয়েছে এ শহরে। আরেফিন নগরের ৪৪ একর জায়গা দখলে চলে গেছে। এসব উচ্ছেদ করতে হবে। একদিনে সমস্যা চিহ্নিত করা যায় না, প্ল্যান করা যায় না। সময় নিয়ে সুন্দর করে প্ল্যান করা দরকার। নিউমার্কেট কেন্দ্রিক থাকলেও হকার এখন ওয়ার্ড পর্যন্ত চলে গেছে। এ একটা সমস্যা। ওয়ার্ডের কোথায় হকার বসবে তা ঠিক করে দিতে হবে। প্রসঙ্গত, নগরীর মাস্টার প্ল্যান তৈরিতে সম্প্রতি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। যাতে করে ওয়ার্ড পর্যায়ের সমস্যা চিহ্নত করে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা যায়।