দুর্যোগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ‘রক্ষাদেয়াল’ সারিবদ্ধ কেয়াবন। পাঁচ বছর আগেও দ্বীপের চারপাশে কেয়াবন ছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার। উজাড় হতে হতে সেই বন এখন ঠেকেছে ৮ কিলোমিটারে। প্রায় ১২ কিলোমিটার কেয়াবন নেই। কেয়াবন ধ্বংসের এই চিত্র জানান পরিবেশবাদী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। অবশিষ্টটুকুও কত দিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তাঁরা।
সেন্ট মার্টিনে কেয়াবন উজাড়ের একমাত্র কারণ হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ। এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে কেয়াবন আগুনে পুড়িয়ে ও কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে সৈকতের বালিয়াড়ি বিলীন হচ্ছে। এর প্রভাবও ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। দুই বছর ধরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হচ্ছে দ্বীপের শত শত নারকেলগাছ ও বসতবাড়ি, যা আগে কখনো হয়নি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
এভাবে কেয়াবন ধ্বংসের পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফিলতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। আর স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ রক্ষাকারী কেয়াবন উজাড়ের প্রতিবাদ করলেও সুফল পাচ্ছেন না। কেননা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রভাবশালীরা ঠিকই পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে অবকাঠামো নির্মাণ অব্যাহত রেখেছেন।
সেন্ট মার্টিনের দুই সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান ও নুর আহমদ চট্টলার কণ্ঠকে বলেন, প্রভাবশালীরা প্রথমে দ্বীপের জায়গা-জমি কেনেন। তারপর লোকজন দিয়ে কেয়াবন পুড়িয়ে ফেলেন বা কেটে ফেলেন। এরপর সেখানে স্থায়ী হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁসহ স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী সেন্ট মার্টিনে পাকা স্থাপনা নির্মাণের সামগ্রী আনার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রায় সব স্থাপনাই পাকা। পরিবেশ অধিদপ্তরের চোখের সামনে এসব হলেও তারা চুপ।
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ। সেন্ট মার্টিন কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগরবক্ষে অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে দ্বীপটি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে গ্রাম আছে ৯টি।
স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে , সেন্ট মার্টিনে প্রথম ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে। এখন ভবন আছে ১৩৮টির বেশি। অথচ মাত্র ৪ বছর আগে ২০১৮ সালে এ ধরনের স্থাপনা ছিল মাত্র ৪৮টি। অর্থাৎ এই চার বছরে ৯০টির মতো স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। এখনো কমপক্ষের ৩০টি স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জেলেরা বলছেন, কেয়াবনের ভেতরেও তৈরি হয়েছে একাধিক রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ। রিসোর্টে পর্যটকদের আনা-নেওয়ায় সৈকতের বালুচর দিয়ে চলাচল করছে শত শত টমটম ও মোটরসাইকেল। যানবাহনের চাকায় মারা পড়ছে লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ সামুদ্রিক নানা প্রাণী। কেয়াবন উজাড় হওয়ায় দুই বছর ধরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যাচ্ছে সেন্ট মার্টিন। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময়ও জলোচ্ছ্বাসে পুরো দ্বীপ তলিয়ে গিয়েছিল।
অথচ প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে এই দ্বীপের সুরক্ষায় পরিবেশ আইন অনুযায়ী রয়েছে ১৪ বিধিনিষেধ। এর মধ্যে অন্যতম দ্বীপে কোনো ধরনের পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এ ছাড়া কেয়াবন উজাড়, কেয়া ফল সংগ্রহ ও বেচাবিক্রিসহ প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, তারা মাছ, রাজকাঁকড়া, সামুদ্রিক শৈবাল আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এসব বিধিনিষেধ কেবল কাগজেই। কোনোটির বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দ্বীপের মধ্যভাগের গলাচিপা এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়। একজন কর্মকর্তাকে ওই কার্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি বেশির ভাগ সময় অবস্থান করেন কক্সবাজার শহরে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সেন্ট মার্টিন কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আজহারুল ইসলাম চট্টলার কণ্ঠকে বলেন, দপ্তরের সেন্ট মার্টিন কার্যালয়ে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। নানা কাজে তাঁকে বাইরে যেতে হয়। এ কারণে দ্বীপে অভিযান চালানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যাচ্ছেন হাজারো পর্যটক। স্পিডবোট, ট্রলার ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটমে) তাঁরা যাচ্ছেন এখানে-সেখানে। সবকিছুই চলছে আগের মতোই।
চলতি মৌসুমে ১ নভেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটক যাওয়া শুরু হয়েছে। এখন টেকনাফ থেকে পর্যটক পরিবহন বন্ধ করা হয়েছে। পর্যটকেরা যাচ্ছেন কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে বড় জাহাজে চড়ে। প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করছেন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি রাতযাপন করেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, দ্বীপের কমবেশি সব এলাকায় কেয়াবন উজাড় করে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ সৈকত, গলাচিপা, উত্তর সৈকত, পশ্চিম সৈকতে বেশি বন ধ্বংস করা হয়েছে।
সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ সৈকতে কেয়াবন উজাড় করে দোতলা রিসোর্ট তৈরি করছেন স্থানীয় বাসিন্দা আবছার কামাল। পাশে চলছে আরও একটি কটেজের নির্মাণকাজ। দ্বীপের মাঝখানে গলাচিপা এলাকার পশ্চিম সৈকতে কেয়াবন উজাড় করে দোতলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবনের পাশেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়। কিন্তু কোনো তদারকি নেই।
আবছার কামাল দাবি করেন, তাঁর নিজের জমিতে তিন মাস ধরে রিসোর্ট নির্মাণ করছেন। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেননি। তাঁকেও কেউ বাধা দেননি।
এদিকে উত্তর সৈকতে একসময় তিন কিলোমিটার কেয়াবন ছিল। এখন আছে মাত্র আধা কিলোমিটার বন। তা-ও নিধন করে রিসোর্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্বীপের পশ্চিম সৈকতের উত্তর থেকে দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার কেয়াবন ছিল। অন্তত ছয় কিলোমিটার বন উজাড় করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বীপের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশেরও একই অবস্থা।
সেন্ট মার্টিন ঘুরে এসে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, ‘আমাদের হিসাবে ১২ কিলোমিটারের বন উজাড় হয়ে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা জেনেও চুপ করে আছেন।’
সেন্ট মার্টিনের কেয়াবন উজাড় করে অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান চট্টলার কণ্ঠকে বলেন, দ্বীপের কেয়াবন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের। তবে তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। কেয়াবন উজাড়ের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থীর এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে ৪ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে ৩ বর্গকিলোমিটারে। বিপরীতে বাড়ছে পর্যটক। তাঁদের আবাসনের জন্য নতুন হোটেল ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।
দেশের বনাঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিনে কেয়াবন ধ্বংসের পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফিলতি দায়ী। কেয়াবনের কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বালু স্থির থাকে, সরে যায় না। এই বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সেন্ট মার্টিনের পরিবেশের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে।