প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রফেসর আব্দুল হক। তার দুই ঘণ্টা পর সভাপতির অবস্থানের প্রতিবাদ জানিয়ে পাল্টা বিজ্ঞপ্তি দেন সাধারণ সম্পাদক। শনিবার (১৪ জানুয়ারি) রাত ১১টার দিকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে দাবি আদায়ের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগ তোলা হয় অধ্যাপক আবদুল হকের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি স্থিতিশীল শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে শিক্ষক সমাজকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহবান জানান ড. সজীব কুমার ঘোষ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় উপাচার্যের প্রতিশ্রুতি ও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে এবং কার্যকরী সভায় সাধারণ সম্পাদকের অনুরোধকে পাত্তা না দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কর্তৃক এই আন্দোলন কর্মসূচি অপ্রয়োজনীয়। দাবি আদায়ের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যই হঠাৎ এই কর্মসূচির আহবান করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, গত বছরের অক্টোবর ও ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত দুইটি সিন্ডিকেট সভার পূর্বে প্রায় শতাধিক প্রমোশন বোর্ড সম্পন্ন হয়েছে এবং নভেম্বর পর্যন্ত আবেদনকৃত বাকি চারটি বোর্ড (ওশোনোগ্রাফি, রসায়ন, ক্রিমিনোলজি ও মাইক্রো বায়োলজি বিভাগ) সর্বশেষ সিন্ডিকেটের পূর্বে প্রমোশন বোর্ডের তারিখ ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু উপাচার্যের অফিসিয়াল ব্যস্ততার কারণে করা যায় নাই- যা হওয়া উচিত ছিল। উপাচার্য এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। খুব সহসা বোর্ডগুলো আহবান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই অবস্থায় আন্দোলনের ডাক দেয়া কতটা প্রয়োজন? আমি মনে করি এই কর্মসূচি উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সমস্যার সমাধান না করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র- ছাত্রীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিঘ্নিত শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত স্বাভাবিক করার জন্য প্রশাসন চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই চেষ্টায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও সম্পৃক্ত করেছেন। আমরা সবাই চাই এই সমস্যার দ্রুত সমাধান। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের এই অন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা করে শিক্ষক সমিতির এই মানববন্ধন কতটা সুচিন্তা প্রসূত্ব? আমি মনে করি এই কর্মসূচি শিক্ষক সমাজকে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখোমুখি করে সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। শিক্ষক সমিতি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে ভূমিকা পালন করতে পারে।
গত ১০ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন শিক্ষক সমিতি ২০২৩ এর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছেন। এমতাবস্থায়, নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্বভার হস্তান্তর করার পূর্ব মুহূর্তে এই কর্মসূচির গুরুত্ব কতটুকু? এই আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় যদি নতুন কর্মসূচির প্রয়োজন হয় এবং নতুন কমিটি যদি এতে বিব্রত বোধ করে তবে এই আন্দেলনের ফলাফল কি? আমি মনে করি তফসিল ঘোষণার পর রুটিন দায়িত্ব পালন ছাড়া বর্তমান কমিটির এই ধরনের কর্মসূচি হঠকারী সিদ্ধান্ত।
গত ২২ জানুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকে সকল সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রম চালিয়েছি। প্রশাসনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর অবস্থার পরিবর্তন হয়। প্রশাসনের সাথে বরাবরই আলোচনায় অনীহা দেখিয়ে আসছেন। আলোচনার পরিবর্তে সরাসরি আন্দোলনে যাওয়ার দিকেই উনার গুরুত্ব প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে বিরাজমান স্থিতিশীল পরিবেশকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া বৈ কিছু নয়।
শিক্ষক সমিতি গঠিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য, কোনো অবস্থাতেই ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করা নয়। সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক ও সদস্যদের পাশ কাটিয়ে একক স্বাক্ষরে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি যে সকল সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের নামে যে হীন প্রক্রিয়া প্রচার করে চলছেন তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ইতিহাসে বিরল। সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক ও সদস্যদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে নেওয়া এ সকল কর্মকাণ্ড শিক্ষক সমিতির ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এহেন বিতর্কিত কার্যকলাপের মাধ্যমে শিক্ষক সমিতির মর্যাদাকে তিনি হেয় করেছেন, যার দায়ভার তিনি এড়াতে পারেন না।
শিক্ষক সমাজের অধিকার আদায়ে আলোচনা ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে যে সমস্যার সমাধান সম্ভব, সেক্ষেত্রে আন্দোলনের কর্মসূচি কতটা যৌক্তিক? আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শিক্ষক সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার মতামত ফোরামে প্রকাশ করেছি। আমার সেই মতামত আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। অহেতুক ও অযৌক্তিক আন্দোলনের চেয়ে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায় উত্তম। আপনাদের মতামতের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আসুন আন্দোলনে না গিয়ে আমরা সমস্যার সমাধানে আলোচনা করি। স্থিতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখি।
এর আগে শনিবার (১৪ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্দোলনের ডাক দেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি।
বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন, সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে গড়িমসি এবং শিক্ষক নিয়োগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির অভিযোগ ও চারুকলা ইনস্টিটিউটে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে চরম ব্যর্থতার অভিযোগ উঠে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সোমবার (১৬ জানুয়ারি) প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে প্রতিবাদী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি। এছাড়া আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি মানববন্ধন থেকে ঘোষণা করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত মাসখানেক ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিতে অন্তঃকোন্দল দেখা যায়। এর মধ্যে গত ৪ জানুয়ারি সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক আব্দুল হক সাধারণ সম্পাদক ছাড়াই একাই সংগঠনটির কার্যনির্বাহী পরিষদের সাধারণ সভা ডাকেন। এছাড়া গত ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি না থাকার বিষয়ে দুটি পাল্টাপাল্টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এসব ঘটনায় সমিতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
জানা যায়, বর্তমান কমিটির সভাপতি ড. সেলিনা আখতার রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন আবদুল হক। তবে বর্তমান উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের সাথে সুসম্পর্ক না থাকায় সভাপতি আবদুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার অভিযোগ আনা হয়। এতে নানা বিষয়ে উপাচার্যের আস্থাভাজন সমিতির সাধারণ সম্পাদক সজীব কুমার ঘোষের সাথে মতবিরোধ দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন সমিতির বেশ কয়েকজন সদস্য।