অনুসন্ধানে জানা গেছে, সঞ্জয় এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাহাবুদ্দিন বিএনপিপন্থী এবং ফেরদৌস, সুভাষ ও হাবীব আওয়ামী লীগের সমর্থক।
ঠিকাদার ও চসিকের একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহ উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক দুই হাজার ৪৯০ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকার প্রকল্পের বিপরীতে গত নভেম্বর মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৩৭ প্যাকেজে এ দরপত্রের মূল্য ২২০ কোটি টাকা। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দরপত্র উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং শেষ হয় ২৭ ডিসেম্বর। গতকাল ওই দরপত্রের জন্য নির্বাচিত ঠিকাদারদের নাম ঘোষণা করার কথা ছিল।
ঠিকাদারদের দাবি, তারা জানতে পেরেছেন ৩৭ প্যাকেজের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২২টি, একটি প্রতিষ্ঠানকে ৮টি এবং অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে চারটি দরপত্রের জন্য বাছাই করা হয়। অর্থাৎ মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান পেয়ে যাচ্ছে ৩৪টি কাজ। বিষয়টি নিয়ে ঠিকাদারদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। এ ক্ষোভ থেকে হামলার ঘটনা ঘটে।
ঠিকাদাররা বলছেন, পূর্বে অনেক কাজ যথাসময়ে শেষ করতে না পারা এবং প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এক প্রতিষ্ঠানকে একাধিক কাজ না দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন রয়েছে। এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নভেম্বর মাসে আহূত দরপত্রের এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি। দরপত্রগুলো এখনো মূল্যায়ন পর্যায়ে আছে।
অভিযোগ আছে, প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ইয়াজদানীর নিয়োগ হওয়ার আগে আহ্বান করা দরপত্রগুলোর মধ্যে কিছু লটারি এবং কিছু পছন্দের ঠিকাদারকে দেয়া হয়।
প্রকল্প পরিচালক যা বললেন : গতকাল বিকেলে নগর ভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের হামলার শিকার প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী জানান, কার্যালয়ে বসার পরপরই অনুমতি ছাড়া প্রায় ২০–২৫ জন ঠিকাদার তার কক্ষে ঢুকে যায়। কথা বলার এক পর্যায়ে অতর্কিতভাবে তার ওপর হামলে পড়েন ঠিকাদারেরা। এ সময় তারা উপর্যুপরি কিল ঘুষি মারতে থাকেন। চাকরি জীবনে কখনো এমন হামলার শিকার হননি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, দরপত্র উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখনো কাউকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। ঠিকাদারদের কাছ থেকে পাওয়া দরপত্র আবেদনের মূল্যায়ন কার্যক্রম চলছিল। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু কয়েকজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার তদবির করতে তার কাছে আসতেন। এতে সায় দেননি। প্রকল্প পরিচালকের দাবি, তিনি ই–জিপি প্রক্রিয়া মেনে ম্যাট্রিঙ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করছিলেন। এ পদ্ধতিতে ঠিকাদারদের প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক কাগজপত্র, টার্নওভার, কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নাম্বারিং করা হয়। এ কারণে ক্ষুদ্ধ হয়ে ঠিকাদারেরা হামলা করেছেন।
প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরের অফিস সহকারী তিলক দে সাংবাদিকদের বলেন, স্যার (প্রকল্প পরিচালক) সভা শেষে রুমে আসেন। এরপর ঠিকাদাররা অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়েন। প্রথমে ভালো করে কথা বললেও হঠাৎ করে স্যারের ওপর হামলে পড়েন। রক্ষা করতে গেলে আমাকে কিল ঘুষি দেন।
ঠিকাদারের বক্তব্য : অভিযুক্ত চসিকের ঠিকাদার সঞ্জয় ভৌমিক চট্টলার কণ্ঠকে বলেন, কাজ না পাওয়ায় পে–অর্ডার ফেরতের বিষয়ে আলোচনা করতে প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরে গিয়েছিলাম। কাজ না পেলে দরপত্র জমা দেওয়ার সময় যে পে–অর্ডার জমা দিই প্রকল্প পরিচালক তা ফেরত দিচ্ছেন না। কেন ফেরত দিচ্ছেন না তা জানতে গিয়েছিলাম। এটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে। কেউ গায়ে হাত তুলেনি এবং ভাঙচুর করেনি। পে–অর্ডার ফেরত চাইতে গেলে প্রকল্প পরিচালক উত্তেজিতভাবে আমাদের বলেন, দুই মাস পে–অর্ডার রাখতে পারেন না, কীসের ঠিকাদার? এ নিয়ে আমাদের মধ্যে উত্তপ্ত কথাবার্তা হয়। পে–অর্ডারগুলো প্রকল্প পরিচালক রিলিজ না করলে আমরা ফেরত পাই না। এটা ফেরত পেতে বিলম্ব হলে আমাদের লস হয়। ২ মাস আগের পে–অর্ডার ফেরত না দেয়ারও অভিযোগ করেন তিনি।
এ ঠিকাদারের অভিযোগ, পিডি ও সিটি কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন মহল মিলে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে কাজ জামায়াতি ঠিকাদারকে দিয়ে দিচ্ছে। ৩৭টি কাজের মধ্যে ৩০টিই দুটি প্রতিষ্ঠানকে ভাগ করে দিয়ে দিচ্ছে।
অভিযুক্ত আরেক ঠিকাদার মো. সাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সিটি কর্পোরেশনেই যাইনি।
সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ভাঙচুরের কথা শুনে আমার নিজের কাছেও অস্বস্তি লাগছে। তাদের কোনো দাবি–দাওয়া থাকলে আমাদের বলতে পারত।
মেয়র যা বললেন : সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্রকল্প পরিচালককে তার দপ্তরে এসে কিছু ঠিকাদার হেনস্থা করেছে। ভাঙচুর করেছে। কর্পোরেশনের কিছু এবং বাইরের কিছু ঠিকাদার এর সঙ্গে জড়িত। ভিডিও ফুটেজ দেখে আমাদের প্রকৌশলী অফিসাররা জড়িতদের চিহ্নিত করেছেন। মামলা করার নির্দেশনা দিয়েছি।
প্রকৌশলীকে হেনস্থা করার কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে বলেন, ঠিকাদাররা আগের মতো অবৈধভাবে টেন্ডার সুবিধা পাচ্ছে না। কারণ বিধি–বিধানের বাইরে প্রকল্প পরিচালক কিছু করেন না। সেজন্য এ ঘটনা ঘটিয়েছে ঠিকাদাররা।
‘পে–অর্ডার ফেরত না দেয়া নিয়ে ঠিকাদারদের অভিযোগ’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, এসব মিথ্যা কথা। পে–অর্ডার ফেরত নেয়ার কোনো সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। এখনো মূল্যায়নই হয়নি, সেখানে পে–অর্ডার কোথা থেকে ফেরত দিবে।
‘নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে।’ ঠিকাদারদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একই প্রতিষ্ঠান একাধিক কাজ পেতে পারে। ইজিপির পদ্ধতিই সেরকম। তবে সেখানে পছন্দের কাউকে দেয়ার সুযোগ নেই। যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড স্ট্রং তারা পেতে পারে। যেমন একজন পাঁচ কোটি টাকার কাজের আবেদন করেছে। কিন্তু সে অতীতে কোনো কাজ করেনি। তখন সে নতুন কাজ পাবে না। কারণ ইজিপির সিস্টেম হচ্ছে পয়েন্টের উপর। এখানে কম্পিউটারই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিকাদার অতীতে কী কাজ করেছে, কত কোটি টাকার কাজ করেছে তা সহ যাবতীয় তথ্যের ভিত্তিতে পয়েন্ট দিয়ে থাকে। যাদের পয়েন্ট বেশি তাদেরকেই কাজ দেয়া হয়।
‘৩৭টি প্যাকেজের মধ্যে তিন প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৩৪টি কাজ পেতে যাচ্ছে।’ ঠিকাদারদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, এখনো চূড়ান্ত কিছু আমার দপ্তরে আসেনি। যদি ঠিকাদারদের কোনো অভিযোগ থাকে তা আমাকে বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলতে পারতেন। কিন্তু তারা যা ঘটিয়েছে তা সমীচীন নয়। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে বলেও জানান মেয়র।
এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের মেয়র বলেন, সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রকল্প পরিচালকের ওপর হামলা করা হয়েছে। সাহাবুদ্দিনসহ হামলাকারী ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। আর অন্যান্য সংস্থাও যাতে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় সে ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হবে।
অন্যান্য : জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন পায়। গত বছরের ১৪ আগস্ট মো. গোলাম ইয়াজদানীকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে অফিস আদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তিনি সপ্তাহে দুদিন চসিকে অফিস করেন। এতে প্রকল্পের কাজে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছিল চসিক।
প্রকল্পটিতে শুরুতে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামকে প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার স্বাক্ষরে গত বছরের ১২ মে দরপত্রও আহ্বান করা হয়। পরে গত ১৪ জুলাই চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) আবু সাদাত মোহাম্মদ তৈয়্যবকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়। তিনিও গত ৭ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করেন।