ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে গত ৪ মে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়। ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ চৌধুরী অভিকে সভাপতি করে গঠিত কমিটিতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের (এমওডিসি) ডা. নুরুল হায়দারকে সদস্য সচিব করা হয়। আর সদস্য করা হয় সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা থোয়াইনু মং মার্মাকে।
সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর স্বাক্ষরে গঠিত এ কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি এ কমিটি। সর্বশেষ গতকাল কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিটির প্রধান ও চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ চৌধুরী অভি প্রতিবেদন জমা দেয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। প্রতিবেদনে ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে বেশ পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বেশ কয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরেজমিনে পরিদর্শন, ভর্তিকৃত রোগী, রোগীর আত্মীয়–স্বজন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এবং হাট–বাজারে আগত লোকজনের সাথে পরিস্থিতি আলোচনা করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে ৫ কারণ চিহ্নিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে–
এক. তীব্র গরম এবং অনাবৃষ্টির কারণে ভূ–অভ্যন্তরে পানির লেয়ার নেমে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির মূল উৎস (যেমন–বিভিন্ন নলকূপ) বিকল হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের নিকট খাবার পানি, গোসল, কাপড় ধোয়া এবং দৈনন্দিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য নিকটস্থ জলাধারের (যেমন–পুকুর নদী ইত্যাদি) পানির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই পানি পান করার ফলে অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ।
দুই. সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায় যে, অগভীর এবং গভীর নলকূপ থেকে যৎসামান্য যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তাতে লবণাক্ততা বেশি। তদুপরি, কর্ণফুলী নদী এবং এর শাখা প্রশাখা তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে জোয়ারের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি সংলগ্ন পুকুর এবং খালের পানি লবণাক্ত করে দিচ্ছে। এই লবণাক্ত পানি পান করে অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।
তিন. তীব্র গরমে পচনশীল খাবারসমূহ স্বাভাবিক সময়ের আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাসা বাড়িতে এই খাবার খেয়ে অনেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত হচ্ছে।
চার. তীব্র গরমে মানুষজন পিপাসা নিবারণে হাট–বাজারে অপরিচ্ছন্ন ও উন্মুক্ত পরিবেশে বিভিন্ন ফলের রস, শরবত ইত্যাদি পান করছে। অনেকে এভাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।
পাঁচ. সাধারণ স্বাস্থ্য বিধি যেমন–শৌচ কার্যের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, বাসন–কোসন পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি কমিটি কয়েক দফা সুপারিশও করেছে প্রতিবেদনে।
কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে– সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট কোনও এলাকা নয় বরং সব এলাকাতেই ডায়রিয়ার প্রকোপ কম বেশি আছে। তবে হাসপাতাল নিকটবর্তী ইউনিয়নের রোগীরা হাসপাতালে বেশি ভর্তি হচ্ছেন। দূরবর্তী এলাকার রোগীরা বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। মারাত্মক ডিহাইড্রেশনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং শিশু রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম।
ব্যবস্থাপনার অংশে বলা হয়েছে– হাসপাতালে আগত রোগীদের ওআরটি কর্ণারে গাইডলাইন অনুসরণ করে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশনের তীব্রতা অনুযায়ী খাবার স্যালাইন বা আইভি স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। এতে করে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত হবে। প্রত্যেক রোগী, রোগীর সাথে আগত লোকজনকে সঠিকভাবে খাবার স্যালাইন প্রস্তুত ও ব্যবহারের নিয়ম শিখিয়ে দিতে হবে।
সুপারিশ : এক. স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য বিধি সমূহ অনুসরণে উৎসাহ প্রদান। দুই. বিশুদ্ধ পানির উৎস বৃদ্ধিকল্পে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং প্রশাসনের সাথে একযোগে কাজ করা।
এদিকে, তিন সদস্যের কমিটি গঠনের পাশাপাশি চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) চিঠি দেয় চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়। সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর স্বাক্ষরে গত ৫ মে আইআইডিসিআর’র পরিচালক বরাবর এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। ডায়রিয়ার আউটব্রেক/ইনভেস্টিগেশন কারণ অনুসন্ধানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
এর প্রেক্ষিতে ১২ সদস্যের একটি টিম পাঠায় আইইডিসিআর। টিমটি মাঠ পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহসহ সার্বিক কার্যক্রম শেষে এরইমাঝে ঢাকায় ফিরে গেছে। মাঠ পর্যায়ে নমুনা ও তথ্য সংগ্রহ করে যাওয়া এ টিমের পক্ষ থেকেও একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।