আজ জাতীয় শোক দিবস, বাঙালির অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ৪৮ বছর আগে এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির মুক্তির দূত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহল।
১৯৭৫ সালের বৃষ্টিঝরা শ্রাবণের এই দিনে বাংলার বুকে বৃষ্টির বদলে ঝরেছিল রক্ত। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে বয়ে চলেছিল সেই রক্ত। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে জাতির পিতার বুক থেকে ঝরেছিল লাল রক্ত ঠিক রক্তগোলাপের মতো। এই দিনে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে রচিত হয়েছিলো এক কালিমালিপ্ত অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুদের প্ররোচনায় মানবতার দুশমন, ঘৃণ্য ঘাতকরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক চক্র আর কিছু বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের চক্রান্তের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ এই হত্যাকাণ্ড। সেনাবাহিনীর এক দল বিপথগামী সদস্যের বুলেটের নির্মম আঘাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল এবং দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল। ইতিহাসের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে সেদিন আরো প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগনে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু সুকান্তবাবু, আরিফ রিন্টু খানসহ অনেকে। এ কারণে বেদনাবিধূর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন আজ। এখানে উল্লেখ করতে পারি, সেদিন আল্লাহর অসীম কৃপায় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধীরা। তারা শুরু করে নানা চক্রান্ত। এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাদের রোষানলে পড়ে এদেশের জনসাধারণ বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে তারা জারি করেছিল কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি ঘটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালির মুক্তির দূত। যেখানে সংকট, যেখানে সংগ্রাম, যেখানে সংঘাত দেখেছেন; বঙ্গবন্ধু এসে দাঁড়িয়েছেন সবার আগে। মরণকে তিনি কখনও ভয় করেননি। তিনি দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন, দেশকে ভালোবেসেছেন। এ ভালোবাসা তাঁর আমৃত্যু অটুট ছিল। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, গোটা জাতির স্বপ্নের রূপকার। তাঁর ‘ইস্পাতকঠিন নেতৃত্ব আর অভীক লড়াকু সত্তা’ বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অধিকার আদায়ের অনিঃশেষ প্রেরণা। তিনি বাঙালির বিশ্বজয়ের মহানায়ক এবং ঐক্য, প্রেরণা ও স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক।