ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে এ বছরের অক্টোবর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ ও বিনিময় নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে আগামীকাল বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) বৈঠকে বসবে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি।
বৈঠক থেকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
রাজধানী ঢাকার মৎস্য ভবনে মৎস্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বন্ধের সময় নির্ধারণ ও মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২২ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। বৈঠক থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ চলাকালীন জেলেদের সরকার ভিজিএফ খাদ্য সহায়তার ঘোষণাও দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নানাবিধ উদ্যোগে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে গ্রামগঞ্জে এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। রপ্তানিও করা হচ্ছে। ইলিশ রক্ষায়, ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। দিনে অভিযানের পাশাপাশি রাতেও অভিযান জোরদার করা হবে। সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলায় বরফ কল বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। গত বছরের ন্যায় এবারও অবৈধ জাল উৎপাদনস্থলে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
অবৈধ পথে ইলিশ পাচার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইলিশ সম্পৃক্ত জেলা উপজেলায় নদীতে ড্রেজিং বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। ইলিশের নিরাপদ প্রজননের মাধ্যমে ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে যা যা করা দরকার তা করা হবে। এছাড়া মাছ ধরা বন্ধের সময় যাচাই-বাছাই করে নিবন্ধিত জেলেদের নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় থাকে। একই সঙ্গে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানা গেছে।
বৈঠকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব শ্যামল চন্দ্র কর্মকার, মো. তৌফিকুল আরিফ, এ টি এম মোস্তফা কামাল ও মো. আব্দূল কাইয়ূম, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের পরিচালক মো. মনজুর হাসান ভুঁইয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএ, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, র্যাব, নৌ পুলিশ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক, মৎস্য বিজ্ঞানী, ইলিশ সম্পৃক্ত জেলাসমূহের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারগণ, ওয়ার্ল্ড ফিশের প্রতিনিধি, মৎস্যজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) সূত্রে জানা গেছে, একটি ইলিশ ৩ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠা পানিতে ডিম দেওয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তী সময়ে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫) সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠা পানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে। ইলিশ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে এ মাছ প্রধানত ডিম ছাড়ে। এ জন্য চলতি বছরে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) মোট ২২ দিন ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুটি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারা জীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপরটি মিঠা পানি ও লোনা পানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭১ কিলোমিটার অভিপ্রয়াণ করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭৫ ভাগ বাংলাদেশ আহরণ করে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, মিয়ানমার এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত। ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন ছিল। সরকার গৃহীত ব্যবস্থাপনা ও কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ফলে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
এদিকে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ২০১৯ সালে ২৪৬ কোটি টাকার ‘ইলিশ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ হাতে নেয় মৎস্য অধিদপ্তর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ৪ বছরে বার্ষিক উৎপাদন ৬ লাখ ২০ হাজার টন বা ১৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে ৩ বছরে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম।
২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২১-২২ সালে প্রবৃদ্ধির হার আরও কমে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মৎস্য অধিদপ্তর এখনো ২০২২-২৩ অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করেনি