স্মরণকালের বৃহত্তম জশনে জুলুস উদযাপিত হলো

ইমরান নাজির।

বৃহস্পতিবার উদযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। এ উপলক্ষে আন্‌জুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামে সম্পন্ন হলো স্মরণকালের বৃহত্তম জশনে জুলুস। ওইদিন উৎসবে রূপ নেয় চট্টগ্রামের জশনে জুলুস। সকাল ৯টায় ষোলশহর আলমগীর খানক্বাহ্‌ শরীফ থেকে বের হয়ে এই জুলুস চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহ প্রদক্ষিণ করে দুপুর দেড়টায় ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা ময়দানে এসে বিশাল মাহফিলে মিলাদ–কিয়াম ও মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। এবারের জশ্‌নে জুলুসটি ছিল আনজুমান ট্রাস্টের ৫১তম আয়োজন। ১৯৭৪ (১৩৯৪ হিজরি) বলুয়ারদীঘি খানকাহ্‌ শরীফ থেকে ছিল এর সূচনা। ৫১তম বর্ষে এবারের জুলুসে যোগদান করেছে অন্তত ৫০/৬০ লাখ মানুষ। জুলুস উপলক্ষে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে ছিল বাড়তি উৎসাহ উদ্দীপনা। এ উপলক্ষে আগে থেকে সুসজ্জিত ও আলোকিত করা হয় নগরী। জশ্‌নে জুলুস বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আপামর জনতার উৎসবে রূপ নিয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর হতে না হতেই শহরের অলি গলি হতে মাইকে নাতে রাসুলের (দ.) সম্প্রচার শুরু হয়। সুসজ্জিত গাড়িগুলো ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা দিকে ছুটছে। বিভিন্ন জেলা থেকেও জুলুসে যোগদানের জন্য গাড়ির বহর এসেছে। নগরের অসংখ্য স্পটে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সেবাদান কার্যক্রম। কেউ দিচ্ছিল শরবত, পানি বা কেহ দিচ্ছিল শুকনা খাবার, ফল মূল, বিরিয়ানির প্যাকেটসহ নানা কিছু। কেউ বিতরণ করছিল চকলেট, ঠাণ্ডা পানীয়, এমনকি টিস্যুও। চট্টগ্রামের এপোলো ইমপেরিয়াল হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়েছে চিকিৎসা সহায়তা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষের ছিল নজিরবিহীন নিরাপত্তা সেবা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা নিজ নিজ অবয়বে জুলুসে অংশগ্রহণ করে। ছিল গণমাধ্যমকর্মীদের সক্রিয় বিচরণ। এককথায় বলা যায়, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) এর জশ্‌নে জুলুস চট্টগ্রামে প্রধান উৎসবে রূপ নিয়েছে ওইদিন। বিশেষত জুলুসে অংশগ্রহণকারীদের সবার মুখে ছিল হামদ, না’ত, সালাত–সালাম আর আল্লাহু আকবর– এয়া রাসুলাল্লাহ্‌ (দ.) ধ্বনি। জুলুসে অংশগ্রহণকারীদের এই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে শহরের দালান–কোঠা, ফ্লাইওভার গুলোতে নারী–শিশুসহ ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের অধীর অপেক্ষা দেখা যায়। তাঁরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন জুলুস যাত্রী এবং এর নেতৃত্বদানকারী হুজুর কেবলা পীর সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্‌ ও শাহজাদা সৈয়্যদ মুহাম্মদ কাসেম শাহ্‌কে বহনকারী সুসজ্জিত গাড়িকে। যেহেতু, সকাল ৯টায় জুলুসটি বের হবার সময়েই সুন্নিয়া মাদ্রাসার সম্মুখস্থ উভয় ময়দান ছিল মুসল্লিতে পরিপূর্ণ, তাই জশ্‌নে জুলুসে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষ ময়দান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। সকাল ৯টার পরপরই একই সাথে হুজুর কেবলা সাবির শাহ্‌’র নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরে জুলুস এবং জামেয়া ময়দানে চলতে থাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের বক্তব্য। তাঁরা জশ্‌নে জুলুসের মতো এমন একটি পরিশীলিত শরীয়তসম্মত কালচার প্রতিষ্ঠার জন্য গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.)’র শুকরিয়া আদায় করেন। ওলামায়ে কেরাম বলেন, হযরত তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.) জশ্‌নে জুলুস দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবেদনকে যেমনি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন, ঠিক তেমনি গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র মতো মানবিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মানুষকে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে পাশে থেকে নজিরবিহীন সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। জশ্‌নে জুলুসে পীর সাবির শাহ্‌কে বহনকারী গাড়িটি জোহরের সময়ে জামেয়া ময়দানে এসে পৌঁছালে প্রথমে জোহরের নামাজ আদায় করেন। রাহনুমায়ে শরিয়ত ও ত্বরিকত, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্‌ হুজুরের সভাপতিত্বে ময়দানে অনুষ্ঠিত সমাপনী মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পীর সাবির শাহ্‌ বলেন, কুরআনে পাকে আমাদের রাসুল (দ.)কে শুধু মুসলমানদের জন্য নন বরং মুসলিম–অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত বা কল্যাণ বলে উল্লেখ করে তাঁর মিলাদের প্রধান বাণীর তাৎপর্য হলো সকল ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। উগ্রতা এবং জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের নামে চালানো যাবে না। ইসলামের উদ্দেশ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা। হানাহানি ও জবরদস্তি করে ইসলামের বদনাম যেন প্রশ্রয় না পায় সেটা আমাদের দেখতে হবে। তিনি বলেন, আজ চট্টগ্রামে বিশ্বের সেরা জশ্‌নে জুলুস উদযাপিত হয়েছে। হিজরতের সময়ে মদিনার আনসার সাহাবারা যেভাবে কাসিদাহ্‌ গেয়ে গেয়ে জুলুসের মাধ্যমে নবী করিম (দ.) কে মদিনায় স্বাগত জানিয়েছেন ঠিক সেই সুন্নাতের অনুসরণ করেছেন আজ চট্টগ্রামের নবী প্রেমিক জনতা। পবিত্র কুরআন–হাদীসের আলোকে এরূপ ইশক্ব রাসুলের বহিঃপ্রকাশের কারণে বাংলাদেশ দিন দিন উন্নতির দিকে এগুচ্ছে উল্লেখ করে তিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এ জুলুস স্থান পেলে শুধু বাংলাদেশ বা চট্টগ্রাম নয় গিনেস বুক কর্তৃপক্ষও সম্মানিত হবে বলে মত প্রকাশ করেন। জুলুস পরবর্তী জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া ময়দানে এ মাহফিলে বিশেষ অতিথি ছিলেন শাহজাদা আল্লামা কাসেম শাহ্‌ ছাড়াও চ.সি.ক. মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম–৮ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম, পিএইচপি ফ্যামিলি চেয়ারম্যান সুফী মিজানুর রহমান, রাজনীতিবিদ ডা. শাহাদাত হোসেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ–সচিব মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে স্বাগত ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন– আন্‌জুমান ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মহসিন ও সেক্রেটারি জেনারেল আনোয়ার হোসেন। ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মহসিন তাঁর বক্তব্যে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) জাতীয়ভাবে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালন করতে সরকারি নির্দেশনা প্রদান করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ ও জুলুসে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য স্থানীয় প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, পুলিশ প্রশাসন, সকল গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাবসহ সকল মিডিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জশ্‌নে জুলুস সফল করায় সর্বস্তরের মুসলমানদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এতে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আন্‌জুমান ট্রাস্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমদ কামরুল চৌধুরী, আমির হোসেন সোহেল, এডিশনাল সেক্রেটারি সামশুদ্দিন, জয়েন্ট সেক্রেটারি সিরাজুল হক, এসিসট্যান্ট সেক্রেটারি এস.এম গিয়াস উদ্দিন শাকের, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম, ফাইন্যান্স সেক্রেটারি এনামুল হক বাচ্চু, সেক্রেটারি মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম, কেন্দ্রীয় গাউসিয়া কমিটির চেয়ারম্যান পেয়ার মোহাম্মদ, জামেয়ার আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্‌রাসার প্রফেসর আবুল মহসিন মো. ইয়াহিয়া খাঁন, অধ্যক্ষ আল্লামা কাজী আবদুল আলীম রেজভী, আনজুমান ট্রাস্ট’র সদস্য– মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন চৌধুরী, মুহাম্মদ শাহজাদ ইবনে দিদার, মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক, চট্টগ্রাম মহানগর গাউসিয়া কমিটির সভাপতি তছকীর আহমদ, সম্পাদক আবদুল্লাহ, উত্তর জেলার সভাপতি জমির উদ্দিন মাস্টার, সম্পাদক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা গাউসিয়া কমিটির সভাপতি কামরুদ্দিন সবুর, মুহাম্মদ হাবীব উল্লাহ মাস্টারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ।

মাওলানা হাফেজ আনিসুজ্জামান ও মাওলানা আবুল হাসেম আলকাদেরীর সঞ্চালনায় মাহফিলে তাকরীর করেন, আহ্‌লে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান আল্লামা কাজী মইনুদ্দিন আশরাফী, গাউসিয়া কমিটির চেয়ারম্যান পেয়ার মোহাম্মদ কমিশনার, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক, মহাসচিব শাহজাদ ইবনে দিদার, যুগ্ম–মহাসচিব মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান প্রফেসর আবুল মহসিন মো. ইয়াহিয়া খাঁন, অধ্যক্ষ হাফেজ কাজী মুহাম্মদ আবদুল আলীম রিজভী, সাবেক অধ্যক্ষ মুফতি সৈয়দ অসিয়র রহমান, মুফতি কাজী আব্দুল ওয়াজেদ, শায়খুল হাদীস হাফেজ মুহাম্মদ সোলায়মান আনসারী, মুহাদ্দিস হাফেজ আশরাফুজ্জামান আল কাদেরী, মুহাদ্দিস জসীম উদ্দিন আযহারী, ঢাকা কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়ার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল কাশেম মুহাম্মদ ফজলুল হক, অধ্যক্ষ বদিউল আলম রিজভী, অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব চৌধুরী, অধ্যক্ষ আবুল কালাম আমিরী, উপাধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ আনোয়ারী প্রমুখ। পরে হুজুর কেবলা আল্ল্ল্লামা পীর সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্‌্‌ (মা. জি. আ.) বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতি কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn