অক্টোবর ৪, ২০২৪ ৬:১১ অপরাহ্ণ

হামুনের প্রভাবে চট্টগ্রামের ৫০ লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত

রহিম উল্লাহ উপল।

ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে প্রায় অর্ধলক্ষ বাড়ি–ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণীতে বলা হয়, এ জেলায় ৪২ হাজার ৯৫৯টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। যার মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ৫ হাজার ১০৫টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ৩২ হাজার ৭৪৯টি। অন্যদিকে হামুনের তান্ডবে পল্লী বিদ্যুতের ৩৫৪টি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে গেছে, বিকল হয়েছে ২৩টি ট্রান্সফরমার। ৪৯৬টি স্থানে তার ছিঁড়ে গেছে। ৮০০টি স্থানে গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

এর সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের হিসেব যোগ করলে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় অর্ধলাখের মত। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার আজাদীকে জানান, হামুনের আঘাতে চট্টগ্রামের ৫ হাজার ৬৭টি বাড়ি–ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৪ হাজার ৭৮ টি বাড়ি–ঘর আংশিক ও ২৮৩টি বাড়ি–ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। মোট ২৫টি ইউনিয়নের ১ লাখ ১১ হাজার ৮১৮ জন মানুষ দুর্গতির শিকার হয়েছেন।

এদিকে দেয়াল ও গাছ চাপায় কক্সবাজারে তিন জনের মৃত্যুর পাশাপাশি ঘরের চালা চাপায় সাতকানিয়ায় মারা গেছেন এক নারী। বাঁশখালীতে ঘরের উপর উপড়ে পড়া গাছের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুইজন। বান্দরবান–চন্দনাইশে কোনো প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও ঝড়ে বিপুল সংখ্যক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। সড়ক–মহাসড়কের উপর গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

কক্সবাজার ও রামু প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে অচল হয়ে পড়েছে কক্সবাজার। নেই বিদ্যুৎ, নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। যদিওবা গতকাল রাত ১১টার দিকে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ আসার খবর পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ এলাকাই ছিল অন্ধকারে। একই সঙ্গে সড়ক–উপসড়কে গাছ উপড়ে বেশির ভাগ এলাকায় বন্ধ যানবাহন চলাচল। দেয়াল ও গাছ চাপায় প্রাণ গেছে তিনজনের। তারা হলেন, কক্সবাজার ৫শহরের পাহাড়তলী এলাকার খুইল্ল্যা মিয়ার ছেলে আবদুল খালেক (৪০), মহেশখালী এলাকার হারাধন দে (৪৫) ও চকরিয়া বদরখালী এলাকার জাফর আহমদের ছেলে আসকর আলী (৪৭)।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় জেলাজুড়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জেলা থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে যোগাযোগও সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ চলছে।

জানা যায়, কুতুবদিয়া দ্বীপের প্রধান আজম সড়কের উভয় পাশে অন্তত ১০–১২ হাজার নানান প্রজাতির গাছ ভেঙে সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে ৫শ ঘরবাড়ি এবং আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজারেরও অধিক। বাড়িঘরের উপর গাছ পড়ে ও দেয়াল ধসে আহত হয়েছে প্রায় ৩০ জন। এছাড়া কৃষিখাতে ৫০ হেক্টর আমন ধান ও ৩৫ হেক্টর জমিতে ফলিত শীতকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে অন্তত ১৫ হাজার বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। যার মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ঘর সাড়ে ৫ হাজার। অন্যান্যগুলো আংশিক।

চকরিয়া প্রতিনিধি জানান, উপজেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসেবে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের অন্তত পাঁচ শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অনেক বসতবাড়ির চালা পর্যন্ত উড়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর ওপর গাছপালা ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন। চূড়ান্তভাবে হামুন আঘাত হানার আগে মঙ্গলবার রাত আটটার পর থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে সড়কের ওপর গিয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি জানিয়েছে, চকরিয়া–পেকুয়ায় পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। চালু করতে কয়েকদিন লাগবে।

পেকুয়া প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়েছে পেকুয়া উপজেলার সব–ক‘টি ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার ঘরবাড়ি। এখনো পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিহীন পুরো উপজেলা।

সাতকানিয়া প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ এর আঘাতে সাতকানিয়ায় গাছ উপড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হওয়া বসতঘরের চালের নিচে চাপা পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম বকুমা খাতুন (৬৫)। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে দুই শতাধিক বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুটি উপড়ে ও ভেঙে যাওয়ায় এবং সঞ্চালন লাইনের উপর গাছ ভেঙে পড়ায় বিদ্যুৎ সরবারাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। গতকাল বিকাল থেকে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করলেও এখনো বেশির ভাগ এলাকা অন্ধকারে রয়েছে। ঘরের চালের নিচে চাপা পড়ে মারা যাওয়া বকুমা খাতুন উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝের পাড়ার মৃত নুর আহমদের স্ত্রী।

পল্লী বিদ্যুতের সাতকানিয়া জোনাল অফিসের ডিজিএম মো. সাইফুল আলম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাতকানিয়া জোনাল অফিসের অওতাধীন এলাকায় ৩৬ বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে। উপড়ে গেছে ২৩টি। এছাড়া ২৭০টি স্থানে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উপর গাছ ভেঙে পড়েছে। এজন্য ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন খুঁটি থেকে খুটি এভাবে লাইন চেক করে বিদ্যুৎ চালু করা হচ্ছে। বর্তমানে কিছু এলাকায় লাইন চালু করা হয়েছে। অন্যান্য এলাকায় এখনো বন্ধ রয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু করতে পারবো।

বাঁশখালী প্রতিনিধি জানান, বাঁশখালীতে ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রচন্ড বাতাসে পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়নে অন্তত কয়েক হাজার ঘর–বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ের কবলে পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক নারীসহ দুইজনের। বাঁশখালীর প্রায় সব কয়টি গ্রামে বাড়িঘর, গাছ ভেঙে পড়ে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন বাইরে অবস্থানকালে সরল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড উত্তর সরল গ্রামের কবির আহমদের স্ত্রী মমতাজ বেগম (৭০) এবং বাড়ির উপর গাছ পড়ে কাথরিয়া ইউনিয়নের কোর্ট পাড়ায় ফজল আহমদের পুত্র মমতাজ উদ্দিন (৬০) নামে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

বাঁশখালীর প্রধান সড়কে গাছ পড়ে মঙ্গলবার রাত থেকে যোগাযোগ বন্ধ ছিল তা বুধবার দুপুরে স্বাভাবিক করা হয়। প্রচন্ড বাতাসের তোড়ে বাঁশখালীতে বিদ্যুতের শতাধিক খুটি উপড়ে ও ভেঙে পড়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, ঘূর্ণিঝড় হামুনে পুরো বাঁশখালীতে বিপুল সংখ্যক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, প্রধান সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হলেও অভ্যন্তরীণ অবস্থা অনেক নাজুক। ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে জনপ্রতিনিধি ও ট্যাগ অফিসারগণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের তান্ডবে চন্দনাইশের ২টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপড়ে পড়েছে হাজার হাজার গাছপালা। উপড়ে পড়া অধিকাংশ গাছপালাই পড়েছে সড়ক–মহাসড়ক, ঘরবাড়ি ও বাউন্ডারি দেয়ালের উপর। অধিকাংশ এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি পড়ে গেছে, ছিড়ে গেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের তার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার। ফলে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে অন্ধকার নেমে আসে চারিদিকে।

বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানে ঘূর্ণিঝড় হামুন এর আঘাতে ঝড় বাতাসে বিভিন্ন স্থানে গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি এবং ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল জেলায়। বুধবার বিকাল ৩টার সময় ত্রুটিপূর্ণ লাইন মেরামতের পর বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালু করা হয়।

জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে জেলায় বিভিন্নস্থানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রাণহাণির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করা হবে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক