চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা মো. শাহীন। দারিদ্রতায় জর্জরিত এই যুবক পেশায় অটোরিকশাচালক। হঠাৎ একদিন বন্ধুর মাধ্যমে আসে বিদেশে চাকরির প্রস্তাব। ২০ হাজার টাকা বেতন, দৈনিক ৩০০ টাকা হাতখরচ! সাত-পাঁচ না ভেবেই ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে রাজি হয়ে যান শাহীন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি— মানবপাচার চক্রের হাতে পড়েছেন তিনি। তার বন্ধুই তাকে টাকার লোভে চক্রের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটে শুধু তার বন্ধু নয়, জড়িত অনেক বাংলাদেশি ও একাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক।
শাহীন যখন বুঝতে পারেন তখন আর কিছু করার ছিল না তার। জিম্মিদশায় তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মিয়ানমারে। সেখানে পৌঁছানোর পরপরই মুক্তিপণের টাকার জন্য চাপ দেওয়া হয় তাঁর পরিবারকে। আর সেই টাকা না দিতে তাঁর ওপর চলে নিষ্ঠুরতার সীমা ছাড়ানো নির্যাতন-নিপীড়ন। এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে জীবনে শাহীন সর্বনাশ ডেকে আনলেও আরেক বন্ধু বন্দি থাকা অবস্থায় আসে রক্ষক হয়ে। নানা চড়াই-উৎরাই পার করে তিনি ফেরেন দেশে। এখনো তাকে তাড়া করে বেড়ায় অজানা এক আতঙ্ক। চোখে-মুখে স্পষ্ট সেই আতঙ্কের ছাপ। যদিও পাচারের সাথে জড়িত দুজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
দেশে ফেরার পর গত মঙ্গলবার এই প্রতিবেদকের কথা হয় শাহীনের সাথে। ‘নতুন জীবন’ পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও দুই মাসের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি মনে পড়তেই বিমর্ষতা ভর করে তার ওপর। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বর্ণনা দেন পুরো ঘটনার।
মো. শাহীন বলেন, ‘আমাদের একটা বন্ধু ছিল। আমরা একসাথে অটোরিকশা চালাতাম। আমাদের দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচয়। তার মাধ্যমে কক্সবাজারের ইয়াছির নামে এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। তার সাথেও আমার বন্ধুত্ব হয়। সে আমাকে হঠাৎ একদিন বিদেশে কাজের জন্য প্রস্তাব দেয়। আমাকে সে বললো—মাসে ২৯ হাজার টাকা বেতনে মিয়ানমারে নৌবাহিনীর একটি প্রজেক্টে লোক নিবে। সেখানে আমাকেও সে চাকরি পাইয়ে দেবে। আমি তার কথামতো যেতে সম্মতি জানাই। বিনিময়ে আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করা হয়। বিদেশ গিয়ে টাকা দেওয়ার বিষয়ে তার সাথে মৌখিক চুক্তি হয় আমার। হঠাৎ চলতি বছরের ১০ অক্টোবর সকালে সে আমাকে ফোন দেয়। বলে, আমরা সবাই বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তুই রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়। সকাল ৮টার দিকে আমিসহ মোট ৩ জন বিদেশ যাওয়ার জন্য নতুন চান্দগাঁও থানার সামনে যাই।’
‘সেখান থেকে বাসে করে আমরা প্রথমে কক্সবাজারের লিংক রোডে পৌঁছাই। সেখানে বাস থেকে নেমে শাহেদ নামে স্থানীয় একজনকে সিএনজি নিয়ে দাঁড়ানো দেখতে পাই। সেই সিএনজিতে করে মোট আমরা ৪ জন টেকনাফ গোলচত্বরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে টেকনাফ যাওয়ার পর আবার সিএনজি থেকে আমাকে নামিয়ে একটি অটোরিকশায় তোলা হয়। তখন আমাকে বলা হয়, তুই এটাতে চলে যা। আমরা সবাই নাশতা নিয়ে আসছি। তুই কোন চিন্তা করিস না। অটোরিকশায় করে অর্ধেক পথ যাওয়ার পর পেছনে আগে থেকে থাকা একজন আমার গলায় ছুরি ধরে। আমি তাকে যাত্রী ভেবেই অটোরিকশায় উঠেছিলাম। এরপর গাড়িচালক দ্রুত গাড়ি নিয়ে একটি জঙ্গলে চলে যায়। সেখানে আরও ৩ জন লোক ছিল। তাদের মধ্যে একজনের হাতে ছুরি ছিল।’- যোগ করেন শাহীন।
বিদেশ যাত্রার নামে পাচার হন অনেকে
শাহীন বলেন, ‘আমাকে যেসব লোকের হাতে তুলে দেওয়া হয় তারা ছিল মূলত রোহিঙ্গা। তারা আমাকে ধরে আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায়। যেখানে একটি ঘরের মতো ছিল। যার ওপরে ত্রিপল দেওয়া এবং চারপাশে টিন। সেখানে গিয়ে আমি আরও ৩০-৪০ জন লোক দেখতে পাই। তাদের কাছে আমি জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়—তাদেরকেও বিদেশ নেওয়ার কথা বলে সেখানে নেওয়া হয়েছে। সেখানে আমাদের ৩ দিন রাখা হয়। ভালোমতো খেতেও পারিনি ওই কয় দিন। শুধু একবেলা করে খাবার দিয়েছে। এরপর আমাদের সেখান থেকে লাম্বুরিপাড়ার শেষ মাথা থেকে আমাদের সবাইকে নৌকায় করে মিয়ানমারের বর্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার সেখান থেকে আমাদের বার্মার নৌকায় তোলা হয়। ওখান থেকে আমাদের মিয়ানমারের সাবিলাপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।’
মাথাপিছু দাম ৮০ হাজার!
মিয়ানমারে পাচারের আগেই দালালচক্র জিম্মি করে রাখা মানুষদের ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন রোহিঙ্গাদের কাছে। সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে শাহীন বলেন, ‘আমাদের মিয়ানমারে নেওয়ার আগেই ৮০ হাজার টাকা করে বিক্রি করে দেওয়া হয় সেখানকার মানুষদের কাছে। এরপর আমাকে যে কিনেছে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারা মূলত আমাদের দিয়ে কাজকর্ম করায় সেখানে। একপ্রকার দাস-দাসীদের প্রথা যেভাবে ছিলো, ঠিক তেমনই।’
বিক্রির পরের জীবন কেমন?
মিয়ানমারে পাচারের পর যার কাছে শাহীনকে বিক্রি করে দেওয়া হয়—সেই লোক আবার লাখ টাকা দাবি করে শাহীনের পরিবারের কাছে। আর টাকা না দিলে ‘অন্য দেশে পাচার’ এবং ‘মেরে ফেলার’ হুমকিও দেওয়া হয় শাহীনের পরিবারকে।
শাহীন বলেন, ‘ওই লোকের মাধ্যমে আমি আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। টাকা নেওয়ার জন্যই তারা আমাকে যোগাযোগ করতে দেয়। কিন্তু যখন আমার পরিবার এত টাকা দিতে পারবে না জানতে পারে, তখন আমাকে অনেকগুলো থাপ্পড় দেওয়া হয় এবং নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন শুরু হয়। তারা খুবই খারাপ মানুষ। এত এত অনুরোধের পরেও তাদের মন গলেনি। পা পর্যন্ত ধরেছি তাদের। আমার মা-বাবা কোনদিন আমার গায়ে হাত দেয়নি। আর তারা আমাকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। টাকা না পেয়ে আমাকে আর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়নি।’
এখনো আটকা শত শত বাংলাদেশি
শাহীন জানান, বর্তমানে মিয়ানমারে এভাবেই বিদেশ পাঠানোর নাম করে পাচার করা দেড়শ থেকে আড়াইশ মানুষ বন্দি রয়েছে। আর তাদের ওপর দিন-রাত চলছে অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন। তাদেরকে শিগগিরই উদ্ধার না করা হলে তাদের প্রাণহানিরও শঙ্কা রয়েছে।
যারা অবৈধপথে বিদেশ যেতে চায় তাদের উদ্দেশ্য করে শাহীন বলেন, ‘আমাদের দেশের ভাই-বোন যারা অবৈধপথে কম খরচে বেশি বেতনের আশায় বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবছেন—আপনাদেরকে সতর্ক করতে চাই, বন্ধু হোক বা বান্ধবী হোক কেউ বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখালে লোভে পড়ে হুট করে চলে যাবেন না। এসব ক্ষেত্রে কিডন্যাপ করে মিয়ানমারে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারে ওদের বড় সিন্ডিকেট। তারা মানুষদের বন্দি করে মিয়ানমারে পাচার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এদের ফাঁদে পড়লে সীমাহীন কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর প্রশাসনের কাছেও বিনীত অনুরোধ— এসব চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আপনারা আইনের আওতায় আনুন।’
বিপদে রক্ষা কবচ হলো ভিনদেশি বন্ধু
বন্ধুর পাল্লায় পড়েই শাহীন পাচারের শিকার। কিন্তু তাকে উদ্ধারে রক্ষক হয়ে এসেছিল আরেক বন্ধু। কিন্তু সেই বন্ধু ভিনদেশি। কথার ফাঁকে মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে শাহীন বলতে শুরু করলেন, ‘এক বন্ধু আমার সর্বনাশ করলেও আমার ওই বিপদে আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় আরেক বন্ধু। সে মিয়ানমারের নাগরিক। ওখানে বন্দি থাকা অবস্থাতেই একদিন তার সাথে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে পরিচয়। তখন আমি তাকে আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলি। সে আমাকে আশ্বাস দেয় আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে দেবে। নামাজ শেষে সে আমাকে নিয়ে যায় সেখানকার স্থানীয় এক গণ্যমাণ্য মুরুব্বির কাছে। আমি তাকে সব ঘটনা খুলে বলার পর আমাকে যে লোকটা কিনেছে তাকে ডেকে পাঠায় সে। তখন তাকে অনেক গালমন্দ করেন ওই মুরুব্বি। পরে আমাকে তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেন এবং তার ঘরে নিয়ে যান। পরে তিনি আমাকে বলেন— ২০ হাজার টাকা যোগাড় কর তুই। আমি তোকে দেশে পাঠিয়ে দেব। তার কথামতো টাকা যোগাড়ের পর তিনি আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। চলতি মাসের ৮ তারিখ আমি দেশের মাটিতে পা রাখি।’
শাহীন বলেন, ‘আমি নিখোঁজের পর অক্টোবরের ১৭ তারিখ থানায় গিয়ে আমার বাবা-মা চান্দগাঁও থানায় গিয়ে মামলা করেন। আমার সাথে আরও দুজন ছিল আমার এলাকার। যারা এখনো মিয়ানমার আটকা। তাদের পরিবারও যতটুকু জেনেছি মামলা করেছে।’
কী হাল শাহীন অপহরণ মামলার
মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির সিভয়েসকে বলেন, ‘এ ঘটনায় এ পর্যন্ত দুজন ভিকটিম উদ্ধার আছে। এছাড়া দুজন বাংলাদেশি যুবককে আটক করা হয়েছে। এখনো একজন ভিকটিম সেখানে আটকা আছেন। তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। আর মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আমরা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে হস্তান্তর করেছি। কিছুদিনের মধ্যে মামলার কাগজপত্র বুঝিয়ে দেব।’
পাচারের ঘটনা নতুন নয়
এর আগে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে অপহরণের শিকার চার কিশোরকে ৫৬ দিন পর কক্সবাজারের টেকনাফে সমুদ্র সৈকতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পেয়ে উদ্ধার করেছে বাকলিয়া থানা পুলিশ। সে সময় গ্রেপ্তার করা হয় অপহারণকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে।
পুলিশ তখন জানিয়েছিল, মূলত চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে চার কিশোরকে প্রথমে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সমুদ্রপথে তাদের মিয়ানমারের একটি এলাকায় নিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়। পুলিশ টেকনাফে থাকা অপহরণকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য এবং দু’দেশের স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করলে তাদের হাত-পা বেঁধে সমুদ্র সৈকতে ফেলে যাওয়া হয়।
অপহরণের শিকার ভিকটিমদের মধ্যে নারীরাও থাকেন। সেখানে তাদের নিয়মিত অমানবিকভাবে মারধর করা হতো। তাদের কান্নার শব্দ ইমো নম্বরে কল দিয়ে শোনানো হতো বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের। এরপর মুক্তিপণের জন্য চাপ দেওয়া হতো।