ডিসেম্বর ৮, ২০২৪ ৩:৫৭ অপরাহ্ণ

তীব্রতর হচ্ছে চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট

ইমরান নাজির।

চট্টগ্রামের গ্যাস খাতে দুঃসংবাদ দিয়ে নয়া বছর শুরু হয়েছে। বছরের প্রথম দিনই চট্টগ্রাম থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মেঘনা ঘাটস্থ বেসরকারি একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এই নির্দেশনা কার্যকর করতে হলে চট্টগ্রামে গত বেশ কিছুদিন ধরে বিরাজমান গ্যাসের সংকট সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে গ্যাসের একমাত্র উৎস আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহে ধস চলছে গত বেশ কিছুদিন ধরে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না থাকায় চট্টগ্রামে রান্না ঘরের চুলা থেকে শুরু করে কলকারখানা এবং সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনসহ সবখানে হাহাকার চলছে। চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহে সংকট দেখা দেয়ায় চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান কমে যায়।

চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪শ’ মিলিয়ন ঘনফুটেরও বেশি। কিন্তু মাত্র আড়াইশ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জোরাজুরি করে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস ব্যবহার করে। এরমধ্যে কাফকো এবং সিইইউএফএল আগে ৮৫ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস নিলেও এখন তারা নিচ্ছে ১শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। যা চট্টগ্রামের সার্বিক গ্যাস প্রবাহে নেতিবাচক আবহ তৈরি করছে। গতকাল কাফকো ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং সিইইউএফএল ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস ব্যবহার করেছে। এর বাইরে শিকলবাহা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার করছে ৩২ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট। ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে সার এবং বিদ্যুতে ১৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চলে যাচ্ছে। বাকি গ্যাস দিয়ে প্রায় ৬ লাখ আবাসিক গ্রাহক, ৬০টিরও বেশি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন এবং অগুনতি বাণিজ্যিক এবং শিল্প গ্রাহকের প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। আর এতে করে চট্টগ্রামের গ্রাহকদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। বিশেষ করে রান্নাবান্নার চুলা দিনের শুরুতে বন্ধ হয়ে যায়। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের রান্নাবান্না করতে ঘরে ঘরে এলপিজি সিলিন্ডার কেনার হিড়িক পড়েছে। সামর্থ্যবানেরা এলপিজি সিলিন্ডার কিনে পরিস্থিতি সামাল দিলেও সামর্থ্যহীনদের দুর্ভোগ চরমে। কেউ কেউ ঘরের মধ্যে ইটের চুলা বানিয়ে রান্না সারছেন। ঘরে ঘরে কয়লা বা কেরোসিনের চুলার ব্যবহার বাড়ছে। এতে শুধু ভোগান্তিই নয়, একই সাথে বাড়ছে ঝুঁকিও। শহুরে বাসাবাড়িতে কয়লা বা কেরোসিনের চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্নার সুযোগ সীমিত।

সূত্র বলেছে, চট্টগ্রামে গ্যাস সেক্টরে ভোগান্তির মূল কারণই হচ্ছে গ্যাস স্বল্পতা। বৃহত্তর চট্টগ্রামে গ্যাসের একমাত্র উৎস হচ্ছে আমদানিকৃত এলএনজি। চট্টগ্রামে আগে আশুগঞ্জ–বাখরাবাদ গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে সিলেট এবং কুমিল্লা অঞ্চল থেকে যে গ্যাস আসতো তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র এলএনজি দিয়েই চট্টগ্রামের শিল্প কারখানা থেকে রান্নাঘরের চুলা পর্যন্ত সবকিছু সামাল দেয়া হয়। বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি পর্যাপ্ত থাকলেই কেবল চট্টগ্রামে গ্যাসের স্বাভাবিক যোগান থাকে। এলএনজি আমদানি কমে যাওয়া কিংবা কোনোভাবে বিঘ্নিত হলেই চট্টগ্রামে গ্যাস থাকার সুযোগ নেই।

মহেশখালী এলএনজি টার্মিনালে সরকারের দুইটি এবং বেসরকারি খাতের একটি বিশেষায়িত জাহাজ এফএসআরইউ থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে এলএনজি সরবরাহ দেয়া হয়। এসব জাহাজে আমদানিকৃত এলএনজি গ্যাসে পরিণত করে পাইপ লাইনে দেয়া হয়। যা সরাসরি চট্টগ্রামে পৌঁছায়। এই পাইপ লাইন ব্যবহার করে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহ দেয়া হচ্ছিল। ওই গ্যাসের মধ্য থেকে চট্টগ্রামের প্রয়োজনীয় গ্যাস এখানে রেখে বাকি গ্যাস ন্যাশনাল গ্রিডে দেয়া হয়। কিন্তু একটি এফএসআরইউ সংস্কারের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর পরই চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগানে ধস নামে। ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের স্থলে বেশ কিছুদিন ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস দেয়া হচ্ছিল। গত কয়েকদিন ধরে তা আরো কমে আসে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের জন্য ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রেখে বাকি গ্যাস নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা অঞ্চলে। কাফকো এবং সিইউএফএল গ্যাসের ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়ায় জোরাজুরি করে আনা গ্যাস সাধারণ গ্রাহকদের কাছে পৌঁছায় না। গতকাল নতুন করে চট্টগ্রাম থেকে আরো ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মেঘনা ঘাটস্থ ইউনিক পাওয়ার প্ল্যান্টে দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে করে চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে আসবে। যা দিয়ে দুইটি বৃহৎ সার কারখানাসহ এতগুলো আবাসিক বাণিজ্যিক এবং শিল্প গ্রাহকের চাহিদা মোকাবেলা অসম্ভব।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মেঘনাস্থ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। যদি এখানে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কমানো হয় তাহলে গ্যাসের চাপ ভয়াবহভাবে কমে যাবে। এতে গ্যাস নির্ভর স্বাভাবিক কাজকর্ম চলবে না। চুলা বন্ধ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের দুইটি সার কারখানার একটি অন্তত সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসের বিদ্যমান প্রেসার কমে গেলে সংকট চরম আকার নেবে। কলকারখানার পাশাপাশি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন এবং আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যমান সংকট চরম আকার ধারণ করবে।

চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান একেবারে তলানিতে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর থেকে কমানো হলে গ্যাস সরবরাহ নেটওয়ার্কের স্বাভাবিক প্রবাহ টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক