ইমরান নাজির।
চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের অপেক্ষায় কেটে গেছে প্রায় আড়াই বছর। হচ্ছে হবে করে করে শেষমেশ দুয়ার আটকে গেছে ‘ত্রুটিযুক্ত’ নকশার কারণে। নকশার ‘ত্রুটি’ চিহ্নিত করে সারানোর দাবাইও পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার সামনে এসেছে নতুন জটিলতা। চলতি বছরের জুনে শেষ হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। আর তাতেই ফের ‘অনিশ্চিয়তার’ মুখে শহীদ মিনারের ‘সংস্কারকাজ’।
প্রকল্পের সময়, কাজ শেষ হওয়ায় বিশেষজ্ঞ কমিটির লিখে দেওয়া দাবাইয়ের অর্থের সংস্থান, বর্ধিত সময়সহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতার মুখে পড়তে যাচ্ছে। ফলে বিশেষজ্ঞ কমিটির ‘দাবাই’ কাজে লাগানো যাচ্ছে না সহসা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি পরিদর্শন করে কিছু সুপারিশ করেছেন সেগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সুপারিশ পর্যালোচনা, ব্যয়, সময়— সবই ঠিক করবে মন্ত্রণালয়।
যদিও এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
জানতে চাইলে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল চট্রলার কন্ঠকে বলেন, ‘প্রজেক্টের প্ল্যান অনুসারে আমরা তো ডিসেম্বর থেকে রেডি ছিলাম। আমরা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। যদি কাজ চলাকালীন সময়ে আপত্তিটা জানাতো তখন অনেক সহজ হয়ে যেতো। এখন যে প্রশাসনিক জটিলতা এটা আসলে সময়সাপেক্ষ। আবার ২৮ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রজেক্ট উদ্বোধনও করে ফেলছেন। এটা আরও জটিলতা। প্রজেক্টও শেষ। সবকিছু মিলিয়ে এখন বিষয়টা কঠিন হয়ে গেছে।’
সংস্কার কাজের আর্থিক ব্যয় প্রসঙ্গে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটাও একটা প্রশ্ন। প্রকল্পটি চলতি বছরের জুন মাসে শেষ। শহীদ মিনার সংস্কারের ব্যয়টা কীভাবে করা হবে সেটাও কিন্তু একটা বিষয়। সবকিছু আসলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করছে। এখন বিশেষজ্ঞ কমিটি পরিদর্শন করে কিছু সুপারিশ করছেন সেগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যাবে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যা যা করা সম্ভব তাই করা হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমাদের সচিব স্যার এসেছিলেন, মেয়র মহোদয় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন যে শহীদ মিনার কেমন হবে। সর্বশেষ মিটিংয়ে আলোচনায় যা বুঝলাম উনারা সেসময় থ্রিডি ডিজাইন দেখে বুঝতে পারেননি, দৃশ্যমান হওয়ার পর বুঝেছেন। শহিদ মিনার গণমানুষের জন্য, এখন মানুষ যা বলবেন তাই হবে। আবার আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি পরিকল্পনা অনুযায়ী সেটাও ঠিক। বলা যায়, দুই দিকেই বিষয়টি ঠিক।’
গত বছরের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের দিন চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পেরও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর নবনির্মিত শহীদ মিনারে বিজয় দিবস উদযাপন করা নিয়ে ১৮ নভেম্বর মতবিনিময় করেন মেয়র। সে সময় সংস্কৃতিকর্মীরা নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ছাড়া এ শহিদ মিনারে ফুল দিতে আপত্তি জানান। সেই প্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর আরেকটি সভা হয়। সভায় অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা চলতি মাসের ৭ ফেব্রুয়ারি মেয়রের সঙ্গে দেখা করে বিশেষজ্ঞ কমিটি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দৃশ্যমান করতে, মিনারের উচ্চতা বাড়াতে এবং প্লাজার ওপরের বেদিতে ওঠানামা সহজ করতে ১০টি সুপারিশ দেয়।
এর মধ্যে— শহীদ মিনারের চারটি স্তম্ভের উচ্চতা বাড়ানো, বেদি আরো দেড় ফুট উঁচু করা, প্লাজার দুইপাশের দেয়ালগুলোর উচ্চতা কিছুটা হ্রাস করা অথবা পারফোরোটেড টাইপ (ছিদ্রযুক্ত) করা এবং প্লাজার দক্ষিণ পূর্বের উন্মুক্ত মঞ্চের পেছনে থাকা গ্রিনরুমের দেওয়ালের উচ্চতা ৬ ফুট রেখে অবশিষ্ট অংশ অপসারণ করা।
দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকা ‘লিলি পন্ড ওয়াটার বডি’ অপসারণ, মূল বেদীর দুই পাশে বাঁকানো গাইড ওয়ালের উচ্চতা কমানো, পূর্ব পাশের প্রবেশ র্যাম্প ও সিঁড়ির মধ্যকার দেয়াল অপসারণ করে পূর্ণাঙ্গ র্যাম্প করার সুপারিশও করেন কমিটির সদস্যরা।
এদিকে সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সমস্যা সমাধান করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ব্যক্তিরা। এ সভার সভাপতিত্ব করেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। সভায় একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসে এবারও মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল ও কলেজ মাঠে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভায় চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘নির্মাণাধীন শহীদ মিনারের দৃশ্যমান না হওয়া এবং সিড়ি সঙ্কীর্ণ ও বয়োবৃদ্ধদের উপযোগী না হওয়া নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। এ বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায় তা বুঝার জন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আমরা একটি কমিটি করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি। কমিটির মতামত ও আজকের সভায় উপস্থিত সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হল এইবারের শহিদ দিবসে গতবারের মতো এবারও মিউনিসিপ্যাল স্কুল প্রাঙ্গণে আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করব।’
প্রসঙ্গত, ১৯২৫ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউট হলটি একদল সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মীরা স্থাপন করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে সরকার হলটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬৩ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউটে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করে পাবলিক লাইব্রেরি। পরবর্তীতে ১৯৯০ এর দশকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের পাশে লাইব্রেরির জন্য একটি চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। মুসলিম ইনস্টিটিউট আধুনিকায়ন ও পাবলিক লাইব্রেরি সম্প্রসারণের জন্য সংস্কৃতিকর্মী ও সুশীল সমাজের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ভেঙে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণ করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে গণপূর্ত বিভাগ। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ও পাবলিক লাইব্রেরির অংশের পুরনো স্থাপনা ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ও আটতলা অডিটরিয়াম ভবন, ২৫০ জন ধারণক্ষমতার একটি উন্মুক্ত গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ এবং ক্যাফে ও মিনি মিউজিয়াম ও নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের শেষদিকে নতুন করে গড়তে ভাঙা হয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি।