চট্টগ্রাম কারাগারে দুধ বিক্রি করছেন ডিআইজি প্রিজন টিপু সুলতান

ইমরান নাজির।

চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) টিপু সুলতান। এই বিভাগের ১১টি কারাগারের বন্দীদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তাঁর। কিন্তু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীদের জন্য প্রতিদিন তিনি যে দুধ সরবরাহ করছেন, তা অবৈধ ব্যবসা। নিজের খামারের গরুর দুধ তিনি কারাগারে বিক্রি করছেন বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে।

কারাবিধি অনুযায়ী, কোনো কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী বন্দীদের কাছে কোনো সামগ্রী বিক্রি কিংবা ভাড়া দিতে পারেন না। এ ছাড়া এভাবে তরল দুধ সরবরাহ করা বন্দীদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সাবেক কারা কর্মকর্তারা।

ডিআইজি প্রিজনের কার্যালয় নগরের লালদীঘির পাড়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্বের সীমানাদেয়াল–সংলগ্ন এলাকায়। কার্যালয়ের পাশেই তাঁর বাংলো। বাংলোর সামনে ১৩টি গরু–বাছুর পালন করেন তিনি। এগুলো দেখভাল করেন সরকারি বেতনভুক্ত কারাগারের চার পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার)। এই চারজন বাইরে গরু খামারে ব্যস্ত থাকায় বাকি পাঁচ পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে প্রায় পাঁচ হাজার বন্দীর কারাগার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হিমশিম খেতে হয়।

এগুলো স্যারের খামারের দুধ। বন্দীদের জন্য কারা ক্যানটিনে বিক্রি করা হয়, লিটার ১০০ টাকা।
আবদুর রশিদ
ডিআইজি প্রিজন যা বললেন

কারাবিধিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘কারাগারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা তাঁর বিশ্বস্ত বা নিযুক্তিয় কোনো ব্যক্তি, কোনো বন্দীর নিকট কোনো দ্রব্য বিক্রয় বা ভাড়া প্রদান করবেন না বা কোনো বন্দীর কোনো দ্রব্য বিক্রয় বা ভাড়া প্রদান হতে অর্জিত সুবিধা বা কোনো টাকা গ্রহণ করবেন না বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো বন্দীর সঙ্গে অন্যান্য ব্যবসায়িক কারবার করবেন না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি প্রিজন টিপু সুলতান  বলেন, ‘দুধ অত বেশি দিই না, সামান্য। দামও বেশি রাখি না। এতে অসুবিধা কী। আগেও দিয়েছি।’

ডিআইজি প্রিজন চট্টগ্রাম বিভাগের কার্যালয় থেকে একটি ভ্যানে করে দুধের ড্রাম নিয়ে যাচ্ছেন দুই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। গত সোমবার সকাল ১০ টা ২১ মিনিটে নগরের লালদীঘি জেল রোডের ডিআইজি প্রিজন কার্যালয়ের মূল ফটকে
ডিআইজি প্রিজন চট্টগ্রাম বিভাগের কার্যালয় থেকে একটি ভ্যানে করে দুধের ড্রাম নিয়ে যাচ্ছেন দুই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। গত সোমবার সকাল ১০ টা ২১ মিনিটে নগরের লালদীঘি জেল রোডের ডিআইজি প্রিজন কার্যালয়ের মূল ফটকেছবি: জুয়েল শীল
কারা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বন্দী থাকেন। গতকাল ছিলেন ৪ হাজার ৩০০ জন। এসব বন্দীর জন্য ১৬–১৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দরকার। আছেন নয়জন। এর মধ্যে চারজন ডিআইজি প্রিজনের গরুর খামারের দেখভাল করেন।
বাংলো থেকে কারাগারে আনার পথে দুধের সঙ্গে কেউ কিছু মিশিয়ে দিতে পারে, এতে বন্দীদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয় কি না, কারা কর্মকর্তা হয়ে কারাগারে দুধ বিক্রি করতে পারেন কি না—এসব প্রশ্নের সব কটির জবাব দেননি টিপু সুলতান। শুধু বলেছেন, ‘দুধ বিক্রি আমার ব্যক্তিগত বিষয়।’ চারজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী কারাগারের কাজ বাদ দিয়ে আপনার খামারে কাজ করছেন কোন নিয়মে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি প্রিজন বলেন, ‘আগে লোকজন আরও বেশি ছিল। আমি কম ব্যবহার করছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেনের কাছে। গতকাল তিনি  বলেন, ‘কেউ অনুমতি নিয়ে দুটি গরু পালন করতে পারেন। কিন্তু ডিআইজি প্রিজনের গরু খামারের দুধ কারাগারে বিক্রির বিষয়টি জানতাম না, আমি দেখছি।’

সরেজমিন গত গতকাল বৃহস্পতিবার  সকাল ১০টা ২১ মিনিটে দেখা যায়, ডিআইজি প্রিজনের কার্যালয়ের ভেতর থেকে একটি ভ্যান গাড়ি করে দুধ নিয়ে বের হচ্ছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. আলমগীর ও সুরেশ চন্দ্র দাশ। ভ্যানের ওপর একটি ড্রাম ও প্যাকেটের ভেতর দুধ। জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ডিআইজির খামারের দুধ কারাগারে নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে কারা ক্যানটিনে দুধ ও দুধ চা বিক্রি হয়। এসব কথা বলতে না বলতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাঁরা ভ্যান নিয়ে ঢুকে পড়েন কারাগারের প্রধান ফটকের ভেতর। আধা ঘণ্টা পর সুরেশ ও আলমগীর ভ্যানটি নিয়ে বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যানের ওপর ঘাসভর্তি প্লাস্টিকের বস্তা দেখা যায়।

গত বছরের ২৬ নভেম্বরও একই চিত্র দেখা গেছে। সেদিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী সুরেশ ও আবদুর রশিদ ভ্যানে করে ড্রামভর্তি দুধ নিয়ে আসেন কারাগারে ডিআইজি প্রিজনের বাংলো থেকে। জানতে চাইলে আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো স্যারের খামারের দুধ। বন্দীদের জন্য কারা ক্যানটিনে বিক্রি করা হয়, লিটার ১০০ টাকা।’

ডিআইজি প্রিজনের কার্যালয়ের সামনের সড়ক–সংলগ্ন মার্কেটে বেশ কয়েকটি হার্ডওয়্যারের দোকান রয়েছে। গত সোমবার পাঁচজন দোকানদারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, প্রতিদিন সকাল ১০টার পর ভ্যানে করে ড্রামভর্তি দুধ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

দুধ বিক্রি আমার ব্যক্তিগত বিষয়:

চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি প্রিজন টিপু সুলতান
পাঁচ হাজারের বেশি বন্দী
কারা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বন্দী থাকেন। গতকাল ছিলেন ৪ হাজার ৩০০ জন। এসব বন্দীর জন্য ১৬–১৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দরকার। আছেন নয়জন। এর মধ্যে চারজন ডিআইজি প্রিজনের গরুর খামারের দেখভাল করেন।

বর্তমানে কারাগারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্দী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন সাবেক সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন, আবু রেজা মুহাম্মদ নদভী, এম এ লতিফ, ফজলে করিম, সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস।

ডিআইজি প্রিজন চট্টগ্রাম বিভাগের কার্যালয় থেকে একটি ভ্যানে করে আনা দুধের ড্রাম নিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকছেন দুই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। গত সোমবার সকাল ১০ টা ২৬ মিনিটে তোলা
ডিআইজি প্রিজন চট্টগ্রাম বিভাগের কার্যালয় থেকে একটি ভ্যানে করে আনা দুধের ড্রাম নিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকছেন দুই পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক